Monkeypox Outbreak: What You Need to Know

ডেঙ্গু ভাইরাসের ভ্যাকসিন ও বর্তমান গবেষণা

Image result for ডেঙ্গু ভাইরাসের
ডেঙ্গু ভাইরাস মহামারি আকারে বাংলাদেশে দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের ঘনবসতি এলাকায় এটাকে মোকাবিলা করা এত সহজ নয়। ডেঙ্গু প্রতিরোধের কোনো ভ্যাকসিন যে নেই, তা নয়। ডেংগভেক্সা নামে একটি ভ্যাকসিন আছে, যা ডেঙ্গু ভাইরাসের চারটি টাইপকে মোকাবিলা করতে পারে। পৃথিবীর ২০টি দেশে এর লাইসেন্স আছে। কিন্তু বর্তমানে ১০ দেশে এটি পাওয়া যায়।


এই ভ্যাকসিনটি নিরাপদ কি না, তা নিশ্চিত করার আগেই ফিলিপাইনে স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের ওপর প্রয়োগ করা নিয়ে বিরাট জটিলতা তৈরি হয়েছিল। এশিয়াতে ফিলিপাইন হচ্ছে একটি অন্যতম ডেঙ্গুপ্রবণ দেশ। ২০১৪ সালে ১০ হাজার শিশুদের ওপর একটি গবেষণা খুবই নামকরা একটি মেডিকেল জার্নাল—লান্সেটে প্রকাশিত হয়। এর নেতৃত্ব দিয়েছিলেন ড. রোজ কেপেডিং। তিনি একজন শিশু চিকিৎসক ও মেডিকেল গবেষক। ফিলিপাইন সরকারের রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ডেঙ্গু ডিপার্টমেন্টের প্রধান ছিলেন।

এই গবেষণাটির ফান্ডিং করে সানফি-পাস্তুর নামে একটি নামকরা ফরাসি কোম্পানি। ভ্যাকসিনটি যখন ফিলিপাইনে অনুমতি লাভ করে, ধারণা করা হয় এটা বাচ্চাদের জন্য নিরাপদ। ডব্লিওএইচও ও সানফি-পাস্তুর, যারা এটার প্রস্তুতকারী, এটাকে নিরাপদ ঘোষণা করে। ডব্লিওএইচওর এক্সপার্ট প্যানেলও এই ভাইরাসটি ৯ বছরের ওপরে ছেলেমেয়েদের জন্য নিরাপদ ঘোষণা দেয়। ফিলিপাইন সরকার তখন ৬৭ মিলিয়ন ডলারের রাষ্ট্রীয় সহায়তায় স্কুলগামী ছেলেমেয়েদের ওপর ভ্যাকসিন ইমিউনাইজেশন প্রোগ্রাম শুরু করে।
কিন্তু আমেরিকার ইউনিফরম ইউনিভার্সিটি অব হেলথ সায়েন্সের একজন নামকরা ডেঙ্গু এক্সপার্ট ড. স্কট হালস্টেড এটার বিষয়ে মারাত্মক উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি জানান, যাদের কোনো দিন ডেঙ্গু হয়নি, তাদের জন্য এই ভ্যাকসিনটি নিরাপদ নয়। কিন্তু ডব্লিওএইচওর একটি এক্সপার্ট প্যানেল এই কথাটি তেমন আমলে নেয়নি। ফিলিপাইনে আনুমানিক এক মিলিয়ন কমবয়সী ছেলেমেয়েদের এই ভ্যাকসিনটি দেওয়া হয়। এর মধ্যে ১৩০ জন মারা যায় এবং ধারণা করা হয় এদের মধ্যে ১৯ জন ডেঙ্গুর এই ভ্যাকসিনের কারণে মারা গেছে।
যদিও এই সংখ্যাগুলো নিয়ে অনেক দ্বিমত আছে। সানফি-পাস্তুর এই ভ্যাকসিনটি ফিলিপাইনের বাজার থেকে প্রত্যাহার করে ২০১৭ সালে। বর্তমানে কেপেডিং, কিছু উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা ও সানফি-পাস্তুরের কিছু কর্মকর্তার ওপর মানুষ হত্যার পাঁচটি মামলা ফিলিপাইনের একটি শহরে বিচারাধীন। এতে দোষী সাব্যস্ত হলে কেপেডিংয়ের আনুমানিক ৪৮ বছরের ওপর জেল হতে পারে। লোভ, রাজনীতি ও অসাধু ব্যবসায়ীদের সংযোগ সিনেমাতে প্রতিনিয়ত দেখানো হয়। বাস্তব জীবনের একটা চমৎকার উদাহরণ হচ্ছে এই কাহিনিটি।
এবার হালস্টেডের উদ্বেগের বিষয়টিতে আসি। অত্যন্ত সহজ ভাষায় বায়োমেডিক্যাল সায়েন্সের একটি গবেষণার বিষয় সম্পর্কে বলার চেষ্টা করছি। বর্তমানে সবাই জেনে গেছেন ডেঙ্গুর দ্বিতীয়বার সংক্রমণ অত্যন্ত বিপজ্জনক। শিশুদের ক্ষেত্রে এই ভ্যাকসিনটি প্রথম সংক্রমণের মতো কাজ করে। ডেঙ্গুর প্রধানত চার ধরনের ভাইরাস টাইপ রয়েছে। আরও এক ধরনের টাইপ আছে বলে এখন জানা যাচ্ছে।
আমাদের শরীরে দুই ধরনের নিরাপত্তাব্যবস্থা রয়েছে। একটিকে আমরা টেকনিক্যাল ভাষায় বলি ‘ইনেট ইমিউনিটি’। এটা আমাদের শরীরের একটি তাৎক্ষণিক ও সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা। আমাদের শরীরে কোনো ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাস ঢুকলে শরীরের কিছু নিরাপত্তারক্ষী শ্বেতকণিকা রয়েছে, এরা তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেয় এদের মেরে ফেলার জন্য। শ্বেতকণিকার ওপরে বিভিন্ন ধরনের প্রোটিনগুলো এই কাজগুলো সম্পন্ন করে। কিন্তু এই ভাইরাসটি যদি আমাদের আবার আক্রমণ করে তখন যাতে এটাকে পরাজিত করা যায়, সে জন্য নিরাপত্তা কোষগুলো ভাইরাসকে দমন করার জন্য একটি প্রোটিন তৈরি করে রাখে।
এটাকে আমরা বলি অ্যান্টিবডি। এই অ্যান্টিবডি তৈরি করার সেলগুলোকে আমরা বলি বি-সেল। ভাইরাসটি আবার আক্রমণ করলে অ্যান্টিবডি ভাইরাসের সঙ্গে যুক্ত হয়ে একে ছড়াতে দেয় না এবং আরেকটি নিরাপত্তারক্ষী শ্বেতকণিকা যাকে আমরা বলি টি-সেল তা ভাইরাসকে মেরে ফেলে। আমাদের শরীরে বিভিন্ন নামের বি-সেল ও টি-সেল রয়েছে। এর মাধ্যমে আমাদের শরীরের আর একটি নিরাপত্তাব্যবস্থা তৈরি থাকে, এটাকে আমরা বলি ‘অ্যাডাপ্টিভ ইমিউনিটি’।
আমাদের শরীর ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্ত হলে শরীরের ইনেট ও অ্যাডাপ্টিভ এই দুই নিরাপত্তাপদ্ধতি সক্রিয় হয়ে কাজ করা শুরু করে। এর খুঁটিনাটি বিষয়গুলো এই লেখার পরিধির বাইরে। শরীরের অ্যাডাপ্টিভ নিরাপত্তাব্যবস্থা ডেঙ্গু ভাইরাসের যে টাইপ দ্বারা সংক্রমিত হয়েছে সেই টাইপের ভাইরাসের অ্যান্টিবডি তৈরি করে রাখে। এ ছাড়া ডেঙ্গুর অন্য টাইপগুলোর অ্যান্টিবডিও তৈরি হয়। কিন্তু অন্য টাইপের অ্যান্টিবডিগুলো বেশি দিন পর্যন্ত সক্রিয় থাকে না।
কাজেই প্রথমবার ডেঙ্গু হলে এটা এত বাজে নয়। কিন্তু দ্বিতীয়বার সংক্রমণ হলে এবং তা যদি ডেঙ্গু ভাইরাসের অন্য টাইপ দ্বারা হয়, এই অ্যান্টিবডিই মারাত্মক ডেঙ্গু রোগ তৈরি করতে পারে। এই বিষয়টিকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ‘অ্যান্টিবডি ডিপেন্ডেন্ট এনহান্সমেন্ট’ (এডিই)। অর্থাৎ অ্যান্টিবডি উপস্থিতির কারণে রোগের প্রচণ্ডতা বেড়ে যাওয়া। ডেঙ্গু ও এইচআইভি ভাইরাসের সংক্রমণের ফলে এটা বেশি দেখা যায়। এই কারণে মশার মাধ্যমে ডেঙ্গু ভাইরাস শরীরে আবার প্রবেশ করলে অ্যান্টিবডি ভাইরাস এর টাইপকে পার্থক্য করতে পারে না এবং ভাইরাসকে দমানোর জন্য এর সঙ্গে যুক্ত হয়। এরপর এই ভাইরাস ও অ্যান্টিবডি যুগল একধরনের শ্বেতকণিকার সঙ্গে যুক্ত হয় এবং ভাইরাস ধোঁকা দিয়ে শ্বেতকণিকাকে সংক্রমিত করে ফেলে। এভাবে শরীরে মারাত্মক ভাইরাসের পরিমাণ বেড়ে যায়। এর ফলে মারাত্মক ডেঙ্গু দেখা দেয়। প্লাজমা লিকেজ হতে পারে ও রোগী ডেঙ্গু শকে চলে যেতে পারে। শিশু, গর্ভবতী নারী এবং যাদের মেটাবলিক রোগ, যেমন ডায়াবেটিস আছে তাদের জন্য এটা অত্যন্ত বিপজ্জনক। এই সময় নিবিড় পরিচর্যা ও প্রচুর ফ্লুয়িড পান করা এবং সম্পূর্ণ ডাক্তারের পরামর্শে থাকতে হবে।
১৯৭৭ থেকে ১৯৭৯ সালে কিউবাতে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হয়েছিল। ডেঙ্গু-১ ভাইরাসটি ছিল মূলত এই সংক্রমণের কারণ। এরপরে আরও দুটি আউট ব্রেক হয় কিউবাতে ডেঙ্গুর। একটি ১৯৮১ সালে এবং আরেকটি ১৯৯৭ সালে। রক্ত পরীক্ষার পর জানা যায় ডেঙ্গু-২ হচ্ছে এই ইনফেকশনের কারণ। আনুমানিক ২০৫টি কেস পাওয়া যায় ১৯৯৭ সালে ১৫ বছরের ওপরের রোগীদের, যাদের ডেঙ্গু হেমোরজিক ফিভার অথবা ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম দেখা যায়। এদের মধ্যে তিনজন বাদে সবাই ১৯৭৭-৭৯ সালের ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছিল। এ ছাড়া যারা ১৯৮১ সালে ডেঙ্গু-২ টাইপ ভাইরাস দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে তাদের মারাত্মক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম ছিল ১৯৯৭ সালে আক্রান্ত রোগীদের থেকে। এই কারণটি এভাবে ব্যাখ্যা করা হয় যে, এদের শরীরে অন্য টাইপ ডেঙ্গু ভাইরাসের অ্যান্টিবডি যথার্থ পরিমাণে তখনো বিদ্যমান ছিল। কিন্তু ১৯৯৭ সালে তার পরিমাণ এমন মাত্রায় চলে যায় তা কোনো ধরনের নিরাপত্তা দিতে পারেনি। অ্যান্টিবডি ডিপেন্ডেন্ট এনহ্যান্সমেন্টের (এডিই) কারণে মারাত্মক ডেঙ্গু রোগের এটা একটা উদাহরণ।
কাজেই, হালস্টেডের ভয় সঠিক বলে প্রমাণিত হয়। সানফি-পাস্তুরের ক্লিনিক্যাল ডেটা পরে প্রমাণ করে কমবয়সী ছেলেমেয়ে যাদের একবার ডেঙ্গু হয়েছে তাদের ক্ষেত্রে এটা কাজ করে। কিন্তু যাদের কখনই ডেঙ্গু হয়নি তাদের ক্ষেত্রে এটা বিপজ্জনক। যদিও এই ভ্যাকসিনটি দেওয়ার ফলে ডেঙ্গুর চার ধরনের ভাইরাসের অ্যান্টিবডি তৈরি হয়। কিন্তু তারপরও এই এডিই দেখা যায় সেই ব্যাপারটার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা কিছুটা জটিল। তাই এই বিষয়টা এই লেখাতে পরিহার করছি। এই ভয়ের ফলে এই ভ্যাকসিনটির প্রয়োগ সীমিত হয়ে পড়ে। যদিও এই ভ্যাকসিনটির ভালো কার্যকারিতা রয়েছে। কিন্তু রিস্ক ফ্যাক্টর অনেক। অন্য নিরাপদ ভ্যাকসিনের সঙ্গে তুলনা করলে এটা অনেক বেশি।
এই বিতর্ক সত্ত্বেও আমেরিকার ফুড ও ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন এ বছরের মে মাসে ডেংগভেক্সা নামে এই ভ্যাকসিনটি শুধু ৯-১৬ বয়সী ছেলেমেয়ে, যারা ডেঙ্গুর প্রকোপ আছে এমন অঞ্চলে বসবাস করে, তাদের জন্য অনুমতি দিয়েছে। এই ভ্যাকসিনটি শুধু তাদের দেওয়া যাবে যাদের আগে একবার ডেঙ্গু হয়েছে এবং যা ল্যাবরেটরিতে রক্ত পরীক্ষার মাধ্যমে নিশ্চিত। এই অঞ্চলগুলো হচ্ছে আমেরিকান টেরিটরি, পুয়েরটোরিকো, গুয়াম, ইউএস ভার্জিন আইল্যান্ড। সম্প্রতি বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে আবার জানা যাচ্ছে ফিলিপাইন আবার এই কন্ট্রোভার্সিয়াল ভ্যাকসিন ডেংগভাক্সা তাদের দেশে অনুমতি দিতে পারে।
এখানে ডেঙ্গু বিষয়ক গবেষণা সম্পর্কে আমরা খুবই সাধারণভাবে জানালাম। ডেঙ্গুর ওপর অনেক গবেষণা হয়েছে ও হচ্ছে। আরও কিছু ভ্যাকসিন নিয়ে গবেষণা চলছে আমেরিকাতে। বিজ্ঞানের গবেষণাগুলো মানুষের কল্যাণের জন্যই করা হয়। অদূরভবিষ্যতে ডেঙ্গুর একটি কার্যকর ভ্যাকসিন এই গবেষণার মাধ্যমেই পাওয়া যাবে। হয়তো ট্রপিক্যাল মেডিসিনের ওপর বড় গবেষণা ইনস্টিটিউট বাংলাদেশেই প্রতিষ্ঠিত হবে। এই আশা তো করাই যায়।
সবশেষে আমি বলব, আমেরিকার মতো দেশে ১২ হাজার ডেঙ্গু রোগীকে সামাল দেওয়া এত সহজ হতো না। কোনো রাজ্যে এটা হলে স্টেট ইমার্জেন্সি ঘোষণা করা হতো। বাংলাদেশ লিমিটেড রিসোর্সে অনেক সাফল্য দেখাচ্ছে। বাংলাদেশের হাসপাতালে জায়গা না থাকা সত্ত্বেও মেডিকেল প্রফেশনালরা যেভাবে এটাকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছেন তা সত্যিই প্রশংসার দাবি রাখে। খালি সমালোচনা না করে, নিজের অবস্থান থেকে ভলান্টিয়ারিং করে, জনগণকে সচেতন করে ডেঙ্গুর এই মহামারি থেকে সম্মিলিতভাবে রক্ষা পাওয়ার চেষ্টা করা উচিত।
তথ্য সূত্র:

Comments

Contact Form

Name

Email *

Message *